ঢাকা,শনিবার, ৪ মে ২০২৪

কক্সবাজারে ছদ্ম ব্যবসায়ীরা ঢাকায় এসে ইয়াবা ডন!

অনলাইন ডেস্ক ::

মা-বাবা নাম রেখেছিলেন হোসেন আলী। বাড়ি কক্সবাজার জেলার উখিয়ার মহাশফির বিল গ্রামে। এলাকায় ইয়াবার ডিলার হিসেবে পরিচিত হোসেন আলীর বিরুদ্ধে স্থানীয় থানায় তিনটি মামলা থাকলেও তিনি পলাতক আসামি। র‌্যাব সদস্যরা গত ১৪ মার্চ রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকা থেকে এক লাখ ২৩ হাজার ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করে মো. আলম নামে একজনকে। এর পরই জানা যায়, এই আলমই উখিয়ার হোসেন আলী। আলম পরিচয়ে কক্সবাজারের কলাতলীতে শামীম হোসেন নামের এক ব্যক্তির ‘শামীম গেস্ট হাউস’ ভাড়া নেন তিনি। পরিচয় দিতেন মাছের পোনা ও জমি কেনাবেচার ব্যবসায়ী হিসেবে। সম্রাট আলম ওরফে হোসেন আলীর সঙ্গে তাঁর ছোট ভাই জসিম উদ্দিন আরমানকেও গ্রেপ্তার করা হয়। জসিম ঢাকা কলেজের ছাত্র।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, শামসুল আলমের তিন ছেলে হোসেন আলী, মোহাম্মদ আলী ও রওশন আলী। তাঁরা তিনজনই ইয়াবা কারবারি। অর্থাৎ ঢাকায় গ্রেপ্তার হওয়া জসিম ওরফে আরমানও মা-বাবার দেওয়া নাম পাল্টেছেন। কক্সবাজারের এ রকম আরো কয়েকজন ছদ্মবেশী ব্যবসায়ী ঢাকায় ইয়াবার বড় ডিলার হয়ে ওঠেন। গত মার্চ মাসেই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) গোয়েন্দাদের অভিযানে এমন আরো দুটি সিন্ডিকেট ধরা পড়েছে। কক্সবাজার শহরে হোটেল ও ডিস (কেবল নেটওয়ার্ক) ব্যবসার আড়ালে ইয়াবা মজুদ করে ঢাকায় এনে বিক্রি করছিলেন তাঁরা। তাঁদের মধ্যে মাহমুদুল হক কক্সবাজারের ‘মেরিন প্লাজা’ নামের একটি হোটেলের ভাড়াটিয়া মালিক। খোরশেদ আলম নামের আরেকজন কক্সবাজার শহরের একটি বড় অংশে ডিস ব্যবসা চালাচ্ছিলেন।

ছদ্মপেশার আড়ালে ইয়াবার নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা এসব কারবারির ব্যাপারে বক্সবাজারের পুলিশ প্রশাসনের কাছে কোনো তথ্যই ছিল না। ডিএনসির গোয়েন্দারা বলছেন, কক্সবাজারের একশ্রেণির ব্যবসায়ী ঢাকায় ইয়াবা আনে বলে তথ্য মিলেছে। তারা আকাশপথে উড়োজাহাজে করে ইয়াবা নিয়ে আসে। ব্যক্তিগত গাড়ি ও বাসেও কিছু চালান আসে। এসব চালান ঢাকার হোটেলে বসেই বেশির ভাগ হাতবদল হয়। আর কিছু চালান অল্প সময়ের জন্য ভাড়া করা ফ্ল্যাটে বসে লেনদেন হয়। ডিএনসি ও র‌্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, কক্সবাজারের এসব ছদ্মবেশী ইয়াবা ডিলারদের খোঁজে তদন্ত চলছে।

গত ১৪ মার্চ রাজধানীর হাজারীবাগের মধুরবাজারের ১৯ নম্বর রোডের ১৫৩/এ নম্বর ‘স্বপ্ননীড়’ বাড়ির দ্বিতীয় তলার ফ্ল্যাট থেকে এক লাখ ২৩ হাজার ইয়াবাসহ আলম, তাঁর ছোট ভাই জসিম উদ্দিন আরমান, সহযোগী সালাউদ্দিন ও মিজানুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব-২। র‌্যাব কর্মকর্তারা তখন জানান, কক্সবাজারের কলাতলী এলাকায় বন্ধুদের নিয়ে চিংড়ি মাছের পোনার ব্যবসা, কটেজ, গাড়ি ও জমি কেনাবেচার ব্যবসা করতেন আলম। একপর্যায়ে মিয়ানমার থেকে আসা এক মাদক ব্যবসায়ীর সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে। এর পর থেকেই ইয়াবা ব্যবসায় মেতে ওঠেন তিনি। তিনি সহোদর জসিম উদ্দিনকেও টেনে নেন অন্ধকার এ জগতে।

উখিয়া থানার ওসি আবুল খায়ের বলেন, ‘হোসেন আলীর বিরুদ্ধে মাদকের তিনটি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে। লোকমুখে শোনা যাচ্ছে সে পরিচয় পাল্টে কক্সবাজারে ব্যবসা করছে। ঢাকায় সে গ্রেপ্তার হয়েছে কি না তা আমরা খোঁজ নিয়ে দেখছি।’

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, উখিয়া থেকে গাঢাকা দিয়ে হোসেন আলী তাঁর নাম পাল্টে শামীম গেস্ট হাউস ইজারা নেন। একই সঙ্গে অন্য ব্যবসাও শুরু করেন। গেস্ট হাউসে ইয়াবা মজুদ করে তিনি ঢাকায় নিয়ে আসেন। তাঁর ভাই মো. আলী এলাকায় আছেন। ফলে গ্রেপ্তারকৃত জসিমের পারিবারিক নাম রওশন আলী বলে ধারণা করা হচ্ছে।

র‌্যাব ২-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আনোয়ার উজ জামান বলেন, ‘আমরা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি। অনুমতি পেলে আলমের পুরো পরিচয়সহ নেটওয়ার্ক নিয়ে কাজ করব।’ তিনি আরো বলেন, প্রাথমিকভাবে জানা গেছে মাত্র তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছিলেন আলম। ঢাকায় গাড়ি কেনাবেচার ব্যবসার আড়ালে তিনি ইয়াবা কারবার করতেন। ছোট ভাই, গাড়িচালক মিজান ও গাড়ির গ্যারেজের মিস্ত্রি সালাউদ্দিনকেও এই অপকর্মের সহযোগী করেন।

গত ৫ মার্চ রাজধানীর সেগুনবাগিচার হোটেল নিউ ইয়র্কের কক্ষ থেকে ২৭ হাজার ইয়াবাসহ মাহমুদুল হক, আসাদুজ্জামান বাবুল ও এনামুল্লাহ নামে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে ডিএনসি। তাঁদের মধ্যে মাহমুদুল কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ এলাকার ‘মেরিন প্লাজা’ হোটেলের ভাড়াটে ‘মালিক’। বাবুল কথিত সাংবাদিক ও মাহমুদুলের সহযোগী। ডিএনসির পরিদর্শক সুমনুর রহমান বলেন, আদালতের নির্দেশে আসামিদের দুই দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। রিমান্ডে দুর্ধর্ষ মাহমুদ মুখ খোলেননি। তবে তদন্তে জানা গেছে, মাহমুদুল হোটেল ব্যবসার আড়ালে কক্সবাজারে ইয়াবাসহ সব মাদকই মজুদ করতেন। তিনি প্রায়ই বিমানে ঢাকায় আসেন। কয়েক বছর আগে তিনি চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারে এসে এক বিএনপি নেতার কাছ থেকে মেরিন প্লাজা হোটেলটি ভাড়া নেন। এরপর সেখানে ব্যবসার আড়ালে ঢাকায় ইয়াবা পাচার শুরু করেন। বড় একটি সিন্ডিকেট রয়েছে তাঁর। তাঁর একাধিক ফ্ল্যাট ও বাড়ির তথ্য পাওয়া গেছে।

এদিকে গত ১৯ মার্চ শাহজাহানপুরের গ্রিন লাইন বাস কাউন্টারের কাছে ইস্টার্ন হোটেল থেকে তিন হাজার ইয়াবাসহ গ্রেপ্তারকৃত খোরশেদ আলমকে এক সপ্তাহের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেছেন ডিএনসির গোয়েন্দারা। সংশ্লিষ্টরা জানায়, কক্সবাজারের ভানু প্লাজা হোটেলের পাশে দুটি ফ্ল্যাটে দুই স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করেন খোরশেদ। ঘোলদীঘিরপাড়ে তাঁর আরেকটি বাড়ি আছে। এর আশপাশের এলাকায় রয়েছে তাঁর ডিশ সংযোগের ব্যবসা। গোয়েন্দা তথ্য ছিল লাখ পিস ইয়াবা ছাড়া ঢাকায় আসেন না খোরশেদ। তবে গ্রেপ্তারের আগে তাঁর চালান হাতবদল হয়ে যায়। তাঁর ডায়েরিতে ৩০-৪০ লাখ টাকার লেনদেনের তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা।

ডিএনসির অতিরিক্ত পরিচালক (গোয়েন্দা) নজরুল ইসলাম সিকদার বলেন, ‘কক্সবাজারে ব্যবসা করে ঢাকায় ইয়াবা ব্যবসা করছেন এমন দুজনকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি। এ ধরনের ছদ্মবেশী মাদক ব্যবসায়ীদের ধরতে আমাদের নজরদারি আছে।’

গ্রেপ্তারকৃত তিন ব্যবসায়ীর ব্যাপারে কক্সবাজার থানার ওসি ফরিদ উদ্দিন খন্দকার বলেন, ‘আমাদের কাছে তাদের ব্যাপারে তেমন তথ্য ছিল না।’ তবে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক (ইনচার্জ) আবুল মনসুর বলেন, ‘তারা মাদক কারবারি বলে তথ্য ছিল। আমরা ওয়াচে ছিলাম। এর আগেই তারা অন্য স্থানে ধরা পড়ে।’ অন্য কারবারিদের ব্যাপারেও নজরদারি আছে বলে জানান ডিবির কর্মকর্তা।

পাঠকের মতামত: